স্টাফ রিপোর্টার :(পর্ব-১): অভাব অনটনের পরিবার। তাই পরিবারের হাল ধরে রাখতে ১২ বছরের কিশোরের কাঁধে জীবিকার বোঝা। পরিবারে ৬ সদস্যের আহারের সন্ধানে কোয়েল পাখি বিক্রির জন্য সারা দিন ব্যস্ত থাকে এই সম্ভাবনাময় কিশোরটি। কিশোরটি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া লেখা করে। কিন্তু কোন মতেই তার প্রতিবেদকের কাছে বিদ্যালয়ের নাম এবং শ্রেণী প্রকাশ করতে রাজি হয়নি।
তার ভয় পত্রিকায় নাম উঠলে হয়তো পরিবারের ক্ষতি হতে পারে। ওই কিশোরে নাম জাহিদ হাসান। বয়স প্রায় ১২ বছর। সে সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের আমতৈল জমসেরপুর (কোনাউরা) গ্রামের মৎসজীবি ইব্রাহিম আলী পুত্র। তার পরিবারে দুই ভাই, দুই বোন আর মা-বাবা রয়েছেন। সে ভাই বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় ভাই পড়া খেলা করছেন। সেও পড়া লেখা ছেড়ে পরিবারে আহার যোগাতে হাল ধরেছে। আজ মঙ্গবার দুপুরে উপজেলার পাশে একটি এলাকায় জাহিদ হাসানকে কোয়েল পাখি বিক্রির করতে দুই কাঁধে করে ৬টি খাঁচা নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়। এসময় তার সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। সে জানায় তার পরিবার অত্যন্ত গরিব। তার পিতা পেশায় একজন মৎসজীবি। এলাকার নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় এবং বাড়ির পাশে দিয়ে প্রবাহমান মাকুন্দা নদীতে মাছ না থাকায় তার পিতা বেকার হয়ে পড়েছে। তাই পরিবারে জীবিকা নির্বাহে কোয়েল পাখি বিক্রি করতে হচ্ছে তাকে। এই কিশোরটি নিজে কোয়েল পাখি বিক্রিতে ব্যস্ত থাকলেও তার ইচ্ছায় বড় ভাই পড়া লেখা করছে।
প্রতিদিন সে ৭শ থেকে ৮শত টাকার কোয়েল পাখি বিক্রি করতে পারে। এতে তার দুই থেকে তিন শত টাকা আয় হয়ে থাকে। জাহিদ হাসান জানায়, অভাবের তাড়নায়ই তাকে এমন কাজ করতে হচ্ছে।
(পর্ব-২): সিলেটের বিশ্বনাথ পৌর এলাকায় ও সমগ্র উপজেলা ব্যাপী প্রায় ৫ শতাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে। এর মধ্যে সংসারের বোঝা কাঁধে নিয়ে পৌরশহর ও এর আশেপাশের সড়কগুলোতে অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক শিশুরা চালাচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহন।
এতে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্বনাথের পৌর শহরের পুলের মুখ, চৌরাস্তা, ১ থেকে ৯ নং ওর্য়াড এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন প্রাপ্ত বয়ষ্ক ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকের মধ্যে চারজন অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক চালক রয়েছে। এসব চালক উপজেলার ৮ টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রতিদিন সকালে পৌর শহরে এসে ৩শ টাকায় রিকশা ভাড়া নেয়।
অনেকের আবার নিজের কেনা টমটম রিক্সা আছে।
এরপর সারাদিন পৌর শহর ও আশেপাশের সড়কগুলোতে যাত্রী টেনে সন্ধ্যার পরে আবার বাড়িতে ফিরে যায়। অনেক সময় এ সব শিশুরা রিকশা চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
ব্যাটারিচালিত রিক্সার চালক
নতুন বাজার এলাকার শিশু রিকশা চালক রাসেলের (১২) সঙ্গে, এ বয়সে রিকশা চালাও কেন জানতে চাইলে সে বলে, ‘কী করমু, গরিব ঘরে জন্ম, তিন ক্লাশ পর্যন্ত লেহাপড়া করছি। অভাবের সংসার, বাবা দিন মজুর, মোগো ছয়জনের পরিবার, হ্যার ওপরে দুই বোন বড়, হের লাইগ্যা বাধ্য অইয়া রিকশা চালাই। হারাদিন রিকশা চালইয়া ৮-৯শ টাহা আয় করি।’
হাবড়া বাজারে কথা হয় অপর শিশু রিকশা চালক সুহেমের (১১) সঙ্গে। সে জানায়, তার বাড়ি এই এলাকায়। চারজনের পরিবারে বাবা নেই। দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ছে সে। অভাবে পড়ে বাধ্য হয়ে সে রিকশা চালায়। এতে যা আয় হয়, সেটা দিয়ে তাদের সংসার চলে।
অন্যদিকে রামপাশা বাজারে এলাকার শিশু রিকশা চালক মাসুম (১৩) সঙ্গে কথা হলে সে বলে, ‘ মোরা দু’ভাই এহন দূর-সম্পর্কের এক খালার বাড়িতে থাহি। ছোট ভাইডা (রশিদ) বাড়ির ধারে প্রাইমারি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে লেহাপড়া করে। প্রত্যেকদিন রিকশা চালায়ে যা পাই তা দিয়ে মোরা দুই ভাই খাইয়া দাইয়া কোনো রকম জীবন চালাইতে আছি।
সংসারে বোঝা কাঁধে নিয়ে বাধ্য হয়ে এসব ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চালাই।
পৌরসভার ৬ নং নম্বর ওয়ার্ডের ভাড়ায় ব্যাটারিচালিত রিকশা মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমার ১৫টি ব্যাটারি চালিত রিকশা আছে। আমি প্রতিদিন প্রতিটি রিকশা একেক জনকে ৩শ টাকা করে ভাড়া দিই। এর মধ্যে আটজন শিশু চালক আছে যারা প্রতিদিন আমার কাছ থেকে রিকশা ভাড়া নিয়ে পৌর শহরে চালায়।
শিশুদের রিকশা ভাড়া দেন কেন, জানতে চাইতে তিনি বলেন, বড়রা দুই-এক দিনের ভাড়া বাকি রাখলেও শিশু চালকরা ভাড়া ঠিকঠাক মতো পরিশোধ করে। সেজন্য শিশু চালকদের ভাড়া দিই।
এ ব্যাপারে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) মুটোফোনে বলেন, পৌরশহরে শিশুরা ব্যাটারিচালিত রিকশা চালায় সেটা আমার জানা নেই। এত অল্প বয়সে শিশুদের রিকশা চালাতে গিয়ে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই কোনো শিশুকে পৌর শহরের মধ্যে রিকশা চালাতে দেওয়া হবে না।
Leave a Reply